মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নামলে সুদহার কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নামলে সুদহার কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে একাধিক বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন—উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, বৈদেশিক ঋণের চাপ, ব্যাংক খাতে অনিয়ম এবং তারল্য সংকট। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর মুদ্রানীতি বজায় রেখেছে এবং পুরোপুরি বাজারভিত্তিক নমনীয় বিনিময় হার পদ্ধতি চালু করেছে।
২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠন এবং ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্ধ-বার্ষিক মুদ্রানীতি বিবৃতিতে (এমপিএস) বলা হয়েছে, এসব উদ্যোগের ফলে মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরতে শুরু করেছে।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে এসব তথ্য জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি গভর্নর, নীতিনির্ধারক ও পরামর্শকবৃন্দ, প্রধান অর্থনীতিবিদ, গবেষণা বিভাগের পরিচালক, মুখপাত্র এবং সহকারী মুখপাত্র।
এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতির হার যতদিন ৭ শতাংশের নিচে স্থায়ীভাবে না আসে, ততদিন নীতি রেপো হার ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত থাকবে। পাশাপাশি, স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটির হার ১১.৫ শতাংশ এবং স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটির হার ৮ শতাংশ পর্যায়ে বজায় রাখা হবে।
জানা গেছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৫.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং ৬.৫ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যে নীতিনির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে নীতি সুদের হার ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নেমে এলে ধাপে ধাপে সুদের হার হ্রাস করা হবে।
রিজার্ভ পুনর্গঠন এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ করবে। এ লক্ষ্যে প্রতিদিন দুই দফায় রেফারেন্স বিনিময় হার প্রকাশ করে বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে, যা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আশঙ্কা করছে, যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কবৃদ্ধি, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির ধীরগতি এবং সরবরাহ চেইনে বিঘ্নের কারণে দেশের রপ্তানি ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হতে পারে। এ অবস্থায় প্রয়োজন অনুযায়ী নীতিগত সুদের হারে সমন্বয় আনা হবে বলে জানানো হয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, কঠোর মুদ্রানীতি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি উৎপাদনশীল খাতকে সহায়তা দিতে প্রণোদনা ও সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ জরুরি। তাদের মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে রপ্তানির বহুমুখীকরণ এবং ব্যাংকিং খাতের সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
আরো পড়ুন
শাকিব খানে তাণ্ডব মুভির ২০২৫ থ্রিলার-অ্যাকশন
বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান
টাকার মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হার: ২০২৪-২৫ সালের চ্যালেঞ্জ এবং ব্যবস্থাপনা
২০২৪–২০২৫ সালের মধ্যে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চাপের প্রভাবে বাংলাদেশি টাকার মানে কিছুটা ওঠানামা দেখা গেছে। বিশেষ করে আমদানি ব্যয়, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, এবং বৈশ্বিক মুদ্রা বাজারে ডলারের শক্ত অবস্থানের কারণে টাকার উপর চাপ তৈরি হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ ও বিনিময় হার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে কাজ করছে, যাতে টাকার মান ধীরে ধীরে ভারসাম্যে ফিরে আসে।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কিছু উপায় কি
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কিছু কার্যকর উপায় রয়েছে। প্রধান প্রধান উপায়গুলো হলো:
- কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণ:
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে ঋণ গ্রহণ কমিয়ে দিতে পারে, যাতে বাজারে অতিরিক্ত টাকা প্রবাহ বন্ধ হয়। - সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ:
বাজেটে সরকারি খরচ নিয়ন্ত্রণ করে অতিরিক্ত অর্থ সৃষ্টির প্রবণতা কমানো। - সরবরাহ বৃদ্ধি:
উৎপাদন বাড়িয়ে বাজারে পণ্য ও সেবার পরিমাণ বাড়ানো, যাতে দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে থাকে। - মূল্য স্থিতিশীলতা রক্ষা:
ভ্রাম্যমাণ বাজার পর্যবেক্ষণ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অবৈধ মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা। - বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ:
মুদ্রাস্ফীতির উপর বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার প্রভাব ফেলে, তাই তা নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। - কর নীতির সমন্বয়:
কর বৃদ্ধি বা হ্রাসের মাধ্যমে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের ওপর চাপ সামঞ্জস্য করা। - সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত পরিকল্পনা:
অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনার মধ্যে সমন্বয় করে স্থিতিশীলতা আনা। - নগদ জমার হার বৃদ্ধি: ব্যাংকগুলোকে বেশি পরিমাণে অর্থ রিজার্ভ হিসেবে রাখতে বাধ্য করার মাধ্যমে বাজারে অর্থের সরবরাহ কমানো যায়।
- যোগান বৃদ্ধি: বাজারে সরবরাহ বাড়াতে পারলে, বিশেষ করে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করলে, দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
- ভোক্তা শিক্ষা: জনগণকে সচেতন করতে হবে যেন তারা অপ্রয়োজনীয় ও অহেতুক কেনাকাটা থেকে বিরত থাকে এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়, বিশেষ করে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে, যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে। এ ধরনের সচেতনতা তাদের ভবিষ্যৎ আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে এবং অপ্রত্যাশিত ঋণের চাপে পড়া থেকে রক্ষা করবে।